সায়ন বিশ্বাস
৩০ জুন : বুধবার সন্ধেয় ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে দেখি, দেশের সৰ্বাধিক প্ৰচারিত বাংলা পত্ৰিকাটি তাদের পোৰ্টালে লিখেছে, ‘অলিম্পিক যোগ্যতা অৰ্জন করতে পারলেন না হিমা দাস ও দ্যুতি চাঁদ’৷ খবরটি নিজেদের পোৰ্টালে লিড্ নিউজ হিসেবেই ক্যারি করছিল তারা৷ অথচ, হিমা দাসের খবরটি বুধবার সকালেই বাৰ্তালিপিতে এক্সক্লুসিভ খবর হিসেবে প্ৰকাশিত হয়৷ ‘এক্সক্লুসিভ’ বলার সুবিধেটাও নিয়ে নিলাম, কারণ অন্য কোনও স্থানীয় পোৰ্টাল বা সংবাদপত্ৰ তখনও এই নিউজ ক্যারি করেনি৷
সে হিমার খবর যাক্, কিন্তু দ্যুতি চাঁদ? তিনি কিন্তু বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সুবিধেজনক জায়গায় থাকার ফলে টোকিও কোয়ালিফাই করেছিলেন৷ অথচ দেশ-বন্দিত সেই পত্ৰিকাটি তাদের পোৰ্টালে লিখল, ‘করেননি’! কিছুক্ষণ পর পোৰ্টাল সেই ‘ভুল’ খবরটি মুছে দিল৷ এডিট্ করে ঠিকঠাক করে নিল৷ সে তারা করবেই, সুবিধে আছে যখন, সুবিধে নেবেই৷ কিন্তু নিউ মিডিয়ার এই সুবিধেগুলির জন্যই কি আজ ক্রীড়া সাংবাদিকতা বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে নয়?
আমরা যারা বিসিসিআই এবং ফিফা-র অ্যাক্রেডিটেড সাংবাদিক, তারা জানি, দীৰ্ঘদিন ধরেই বন্ধ হয়ে আছে এই ক্রীড়া নিয়ামক সংস্থাগুলির সাংবাদিক রেজিস্ট্ৰেশন প্ৰক্রিয়া৷ কেন বন্ধ? আসলে দরকারই নেই৷ দু’বছর ধরে করোনা অতিমারিতে ত্ৰস্ত দুনিয়া৷ যেসব খেলাধূলা হচ্ছে, সব বায়ো-বাবল তৈরি করেই হচ্ছে৷ তাই খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধে দিতেই যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাগুলি, তারা সাংবাদিকদের আপ্যায়ণ করে বাড়তি ঝুঁকি নেবে কেন! তাই প্ৰতিটি খেলার আগে আমাদের মেইল ইনবক্সে টুং করে মেসেজ ঢুকছে৷ মেসেজে লিংক্ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ম্যান্ডেটারি প্ৰেস কনফারেন্সগুলির৷ আর, সেই লিংকে ক্লিক করেই আপনি মূহূৰ্তে পৌঁছে যাচ্ছেন কখনও নতুন দিল্লি, কখনও মুম্বাই, কখনও দুবাই তো কখনও লন্ডন! বিশ্বের এহেন জায়গা বাকি নেই, যেখানে আপনি থাকতে পারছেন না৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্ৰে তো ঘরে বসে-বসেই সেই প্ৰেস মিটে নিজের জিজ্ঞাস্য তুলে ধরতেও পারছেন৷
এটার ইতিবাচক দিক্ অনেক আছে, তা সবাই জানি৷ গোটা বিশ্বই হাতের মুঠোয়। কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্ৰে এর নেতিবাচক দিক্ও নেহাৎ কম নয়৷ এই যে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ গেছে, ক’টা কপিতে আপনি মাঠের বাইরের গল্প পেয়েছেন? এই যে ইউরো বা কোপা চলছে, ক’টা কপিতে খেলোয়াড়দের মাঠের বাইরের অতি সাধারণ স্টোরি উঠে আসছে! সোজা কথায় বলি, পাঠক বা দৰ্শকরা স্ৰেফ ততটাই জানতে বা দেখতে পারছেন, যতটা ভাৰ্চুয়ালি কভার করা যাচ্ছে৷ যতটা ব্ৰডকাস্টাররা ফিড দিচ্ছেন৷ বাকি খবরটা আসছে সেখানকার স্থানীয় মিডিয়ায় যদি প্ৰকাশিত হয়, স্ৰেফ তখনই৷ মানে, স্টোরি বিহাইন্ড দ্য স্টোরির আরও কোনও প্ৰেক্ষিত এই মুহূৰ্তে নেই৷
এই অবস্থায় লোকে আমাদের কাগজের একঘেঁয়ে রিপোৰ্ট কেন পড়বে, আমাদের পোৰ্টালে কেন চোখ রাখবে, কেন দেখবে আমাদের টিভি শো? নতুন কিছু কি দিতে পারছি আমরা? আর স্থানীয় স্তরে খেলাধুলার খ-ও নেই করোনার ঠ্যালায়। ফলে পাঠক, দর্শক বা শ্রোতাদের জন্য রসদ কই আমাদের খেলার খবরে?
বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবসের প্ৰাক-মুহূৰ্তে এই চ্যালেঞ্জগুলি সত্যি বড় থেকে বৃহৎ আকার নিচ্ছে৷ আমরা যারা বরাক উপত্যকার একটি ছোট্ট পরিসরে দাঁড়িয়ে হাৰ্ডকোর ক্রীড়া সাংবাদিকতা করছি, সত্যিই আমাদের পেশা এখন প্ৰশ্নের মুখে৷ একদিকে অতিমারির জেরে ফিল্ড জাৰ্নালিজম লাটে, ‘ওয়াৰ্ক ফ্ৰম হোম’-এর সংস্কৃতি; অন্যদিকে প্ৰযুক্তি ও নিউ মিডিয়ার মাত্ৰাতিরিক্ত দাপাদাপি৷ আপনি এর বাইরে গিয়ে কী আর ব্যতিক্রম করে নেবেন, যা আপনার সাংবাদিকতাকে অন্য মাত্ৰা দেবে?
আপনি খেটেখুটে কোনও একটি স্টোরি তুলে আনলেন পরের দিনের খবরের কাগজের জন্য৷ অথবা রাতের রেডিও বা টিভি বুলেটিনে সম্প্ৰচারের জন্য৷ কিন্তু এর আগেই দেখলেন, কোনও একটা সূত্ৰে সেই খবরের মূল দু’টি লাইন, কিংবা কোনও ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিয়েছেন কোনও অত্যুৎসাহী৷ বা নিউ মিডিয়ায় তা অল্প করে প্রকাশিত হয়ে গেল! ব্যস, আপনার খবরের যে মূল রসদ, সেটাই শেষ! এরপর আপনি যতই কপিটি মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখুন, বা দুৰ্দান্ত সব ফুটেজ দিয়ে সাজান, আপনার সংবাদ কিন্তু আর সেভাবে বিকোবে না৷ আর, সংবাদ যদি নাই বিক্রি হল, তবে সাংবাদিকতা কীসের!
নিউ মিডিয়ার জেরে সংবাদপত্ৰ-শিল্প কতটা বিপন্ন, সেটা সবাই জানেন৷ কিন্তু নিউ মিডিয়া নিজে কি সেরকম বড় শিল্প হয়ে উঠতে পারছে সাংবাদিকদের জন্য? জোগান দিতে পারছে সাংবাদকর্মীদের পেটের ভাত? দিতে পারছে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান? এসব প্ৰশ্নের উত্তর পাওয়া যখন কঠিন হয়ে উঠছিল, ঠিক তখনই মরার ওপর খাড়া হয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য প্রত্যাহ্বান হয়ে উঠল অতিমারি ও ভাৰ্চুয়াল স্পোৰ্টস কভারিংয়ের নতুন অধ্যায়টি৷
তাই এই ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস, শুধু নিজেদের পিঠ চাপড়ানোর দিবস নয়৷ নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর দিনও বটে৷ ক্রীড়া সাংবাদিকরা সৃজনশীল, নতুন-নতুন ভাবনা দিয়েই সব প্ৰতিকূলতা ছাপিয়ে গেছেন তারা৷ অতীত এর সাক্ষী৷ মতি নন্দী থেকে শুরু করে গৌতম ভট্টাচাৰ্য, দেবাশিস দত্ত, লোকেন্দ্ৰ প্ৰতাপ সাহি, সাবা নায়েকন, বিজয় লোকপাল্লি, সুবোধ মল্লবরুয়া, নকুল মণ্ডলদের সামনেও তো অন্যরকম কতশত প্ৰতিকূলতা ছিল৷ কিন্তু তারা সব ছাপিয়ে গেছেন৷ এখনো যাচ্ছেন। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় থাকতে গেলে এইসব প্রত্যাহ্বানের মোকাবিলা করেই এগোতে হবে আমাদেরও...৷